গ্যাস অনুসন্ধান এলাকা বাড়াতে চায় শেভরন
- আপলোড সময় : ২৯-০৩-২০২৫ ০১:৩৩:২৪ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৯-০৩-২০২৫ ০১:৩৩:২৪ পূর্বাহ্ন

সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেটের জালালাবাদ গ্যাস ক্ষেত্রের অধীন এলাকাগুলো তিনটি গ্যাস অনুসন্ধান ব্লকে (ব্লক নম্বর ১২, ১৩ ও ১৪) বিভক্ত। ব্লক তিনটিতে অনুসন্ধান ও উত্তোলন কার্যক্রম চালাচ্ছে মার্কিন বহুজাতিক কো¤পানি শেভরন। এর মধ্যে ১২ নম্বরের কিছু অংশের অনুসন্ধান কার্যক্রম ছেড়ে দিয়েছিল মার্কিন কো¤পানিটি। বর্তমানে আবারো এ ছেড়ে দেয়া অংশ এবং ১১ নম্বর ব্লকের আওতাভুক্ত এলাকায় (সুনামগঞ্জ, শেরপুর ও ময়মনসিংহ) কার্যক্রম সম্প্রসারণে আগ্রহী হয়ে উঠেছে শেভরন।
এসব এলাকায় এককভাবে কাজ পেতে পেট্রোবাংলা ও জ্বালানি বিভাগে প্রস্তাবও দিয়েছে কো¤পানিটি। একই সঙ্গে সেখানে গ্যাস পেলে অফশোর পিএসসির (মূল ভূখ-ের বাইরে সাগরে পাওয়া গ্যাসের উৎপাদন বণ্টন চুক্তি) শর্তে চুক্তি করতে চায় শেভরন। কিন্তু অনশোরে (স্থলভাগে) অফশোর পিএসসির শর্তের চুক্তির বিষয়টি আইনসংগত না হওয়ায় এবং বিগত সরকারের করা জ্বালানি খাতের বিশেষ বিধান বাতিল হয়ে যাওয়ায় এরই মধ্যে শেভরনের ওই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে জ্বালানি বিভাগ।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, ১১ ও ১২ নম্বর ব্লকের বর্ধিত এলাকায় গ্যাস সম্প্রসারণ নিয়ে মাস দুয়েক আগে পেট্রোবাংলার কর্মকর্তাদের সঙ্গে শেভরনের একটি বৈঠক হয়। এছাড়া এসব এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহের কথা জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের শীর্ষ পর্যায়েও চিঠি দিয়েছে মার্কিন বহুজাতিক কো¤পানিটি।
পেট্রোবাংলার নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, নতুন এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধান বাড়ানোর পাশাপাশি বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডে উত্তোলন ও অনুসন্ধান কার্যক্রমে চলমান চুক্তির মেয়াদ ২০৩৪ সাল থেকে বাড়িয়ে ২০৩৯ সাল পর্যন্ত করারও প্রস্তাব দিয়েছে শেভরন। গত জানুয়ারিতে এ প্রস্তাব নিয়ে পেট্রোবাংলা ও শেভরনের মধ্যে একটি বৈঠক হয়। এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে শেভরন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, তারা আমাদেরকে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল। আমরা সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছি। কারণ তাদের সঙ্গে আমাদের ২০৩৪ সাল পর্যন্ত চুক্তি রয়েছে। আমরা দেখতে চাই সংশ্লিষ্ট সময়ে শেভরনের উন্নয়ন কতদূর হয়। ইতিবাচক কোনো কিছু মনে হলে আমরা সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পদক্ষেপ নেব।
জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলার নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানিয়েছে, শেভরন যেসব এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য প্রস্তাব দিয়েছে, সেসব এলাকায় তারা বিনা দরপত্রে কাজ পেতে চায়। একই সঙ্গে অফশোরের জন্য করা পিএসসির আওতায় স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধান চুক্তি করতে চায় তারা। কিন্তু তাদের এ প্রস্তাবের জবাবে পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গভীর সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন অনেক ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ, সে কারণে সেখানে গ্যাসের দর অনেক বেশি হয়ে থাকে। স্থলভাগে ওই দর অনুযায়ী চুক্তি হতে পারে না।
এ বিষয়ে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা বলেন, শেভরনের পক্ষ থেকে ওই বৈঠকে বলা হয় যে বাংলাদেশে তারা দীর্ঘ সময় ধরে গ্যাস সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। অব্যাহতভাবে তারা গ্যাস ফিল্ডের সংস্কারকাজ করছে। তাদের দরপত্রের মাধ্যমে কাজ নিতে হলে তা সময়সাপেক্ষ এবং সেখানে ভালো কোনো কো¤পানি অংশ না নেয়ার সম্ভাবনা বেশি। সেই সঙ্গে শেভরনের উন্নত প্রযুক্তি ও দ্রুত সময়ে অনুসন্ধান কার্যক্রম চালানোর সক্ষমতার কথাও তুলে ধরা হয়।
শেভরন এখন বাংলাদেশে বিবিয়ানা, মৌলভীবাজার ও জালালাবাদ গ্যাস ফিল্ড থেকে গ্যাস উত্তোলন করছে। এর মধ্যে বিবিয়ানা ও জালালাবাদের সঙ্গে করা চুক্তির মেয়াদ ২০৩৪ সাল পর্যন্ত। আর মৌলভীবাজারের মেয়াদ ২০৩৮ সাল পর্যন্ত। এ তিন গ্যাসফিল্ড থেকে দৈনিক ১ হাজার ১১০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করছে কো¤পানিটি, যা মোট গ্যাস সরবরাহের প্রায় ৪০ শতাংশ। দীর্ঘ সময় গ্যাস সরবরাহ করে যাওয়া কো¤পানিটির সরকারের কাছে জ্বালানিটির মূল্য বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ বকেয়া পড়েছে। আড়াই বছর ধরে বকেয়া পাওনা আদায়ে নানাভাবে অব্যাহত প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে কো¤পানিটি।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, গ্যাস সরবরাহ বাবদ শেভরনের পাওনা বকেয়া এখনো ১৬০ মিলিয়ন ডলারের বেশি। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত এ বকেয়া পরিশোধ নিয়ে কোনো সমাধান আসেনি। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর শেভরনসহ বিদেশী জ্বালানি সরবরাহকারী কো¤পানিগুলোর বকেয়া পরিশোধে তৎপর হয়।
এ নিয়ে গত বছরের অক্টোবরে জ্বালানি বিভাগ থেকে শেভরনে একটি চিঠি দেয়া হয়। চিঠিতে বলা হয়, প্রতি মাসের গ্যাস বিলের সঙ্গে ছয় মাসের মধ্যে (নভেম্বর-এপ্রিল) কো¤পানিটির প্রাপ্য পুরো বকেয়া পরিশোধ করা হবে।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, শেভরনের বকেয়া এখন ১৬০ মিলিয়ন ডলারের বেশি। গত বছরের নভেম্বরে প্রতি মাসে ৪০-৪৫ মিলিয়ন ডলার গ্যাস বিলের সঙ্গে বিল পরিশোধ বাড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। নভেম্বরে বিল কিছুটা পরিশোধ হলেও এর পরের মাসগুলোয় বকেয়া তেমন একটা পরিশোধ হয়নি। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় ডলারের সংস্থান করতে না পারায় শেভরনের বকেয়া পরিশোধে বড় কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি।
দেশের স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানে দেশী কো¤পানির পাশাপাশি ঠিকাদার হিসেবে বিদেশী কয়েকটি কো¤পানিও বাপেক্সের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। স্থলভাগে বড় আকারে গত দুই দশকের বেশি সময়ে বহুজাতিক কোনো কো¤পানি বৃহৎ পরিসরে কাজ করছে না। বৃহৎ পরিসরে গ্যাস অনুসন্ধান বাড়াতে এবং বিদেশী কো¤পানিকে স্থলভাগে ডেকে আনতে অনশোর পিএসসি হালনাগাদ করেছে জ্বালানি বিভাগ। বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান উড ম্যাকেনজিকে দিয়ে অনশোরের পিএসসি হালনাগাদের কাজটি এরই মধ্যে চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি জ্বালানি বিভাগে তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন এরই মধ্যে জমাও দিয়েছে। ফলে পেট্রোবাংলার অনশোর পিএসসির আওতায় দরপত্র আহ্বান করলে সেখানে শেভরন দরপত্রে অংশ নিতে পারে।
জ্বালানি বিভাগে দেয়া শেভরনের প্রস্তাবের বিষয়ে লিখিতভাবে জানতে চাইলে সুনির্দিষ্ট করে কোনো উত্তর দেয়নি কো¤পানিটি। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে শেভরন বাংলাদেশের কমিউনিকেশন ম্যানেজার শেখ জাহিদুর রহমান এক ই-মেইল বার্তায় লিখেছেন, শেভরন বাংলাদেশে ৩০ বছর ধরে নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী মূল্যে গ্যাস সরবরাহ করছে। জাতীয় গ্রিডে স্থানীয়ভাবে উত্তোলিত গ্যাসের সবচেয়ে বড় সরবরাহ আসছে শেভরন পরিচালিত বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্র থেকে। এরই মধ্যে গ্যাস ফিল্ডটির সিংহভাগ গ্যাসের মজুদ শেষ হয়ে এসেছে। এ গ্যাস ফিল্ডে শেভরনের চুক্তি আছে ২০৩৪ সাল পর্যন্ত। কো¤পানিটির নতুন করে চুক্তির মেয়াদ আরো পাঁচ বছর বাড়ানো স¤পর্কে জানতে চাইলে বিষয়টিকে ‘বাণিজ্যিক পলিসির বিষয়’ উল্লেখ করে এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি শেভরন।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে স্থানীয় গ্যাসের মজুদ নিশ্চিত ও সরবরাহ পেতে দক্ষ ও উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োজন। এজন্য বিদেশী কোম্পানিগুলো স্থলভাগে বাপেক্সের পাশাপাশি বৃহৎ পরিসরে বিনিয়োগ ও কাজ করতে চাইলে তাদের এ আগ্রহকে কাজে লাগানো যেতে পারে।
ভূতত্ত্ববিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বলেন, অনশোরে গ্যাস অনুসন্ধানে বড় কোনো কো¤পানি কাজ করতে আগ্রহী হলে সরকারের উচিত তাদের প্রস্তাবকে স্বাগত জানানো। বিশেষ করে দক্ষতা ও বৈশ্বিকভাবে কার্যক্ষম হলে যত দ্রুত সম্ভব চুক্তি করে একটি সিদ্ধান্তে আসা প্রয়োজন। কারণ আমাদের এখন গ্যাস দরকার। দ্রুত সময়ে গ্যাস পেলে বিদেশ থেকে আমদানি কমানো যেতে পারে, তাতে বৈদেশিক মুদ্রা অনেক বেশি সাশ্রয় হবে। -বণিক বার্তা
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ